শরিয়তের দৃষ্টিতে প্রচলিত ঈদে মিলাদুন্নবী (সা:) উদযাপন

 

نَحْمَدُهُ وَنُصَلِّي عَلَى رَسُوْلِهِ الْكَرِيمِ - أَمَّا بَعْدُ فَأَعُوْذُ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ بِسْمِ اللهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الإِسْلَامَ دِينًا وَقَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كُلُّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلُّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ وَكُلُّ ضَلَالَةٍ فِي النَّارِ أَوْ كَمَا قَالَ عَلَيْهِ الصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ

 

উপস্থিত সকলকে ধন্যবাদ জানিয়ে কুফর-শিরক আর বিদআতের সয়লাবে ভেসে যাওয়া অধঃপতিত এ সমাজকে আলোর ফুয়ারার দিকে পরিচালিত করতে জাতির আগামী দিনের রাহবার একঝাঁক তরুণ প্রজন্মের বলিষ্ঠ বিবেক জাগ্রত করার মানসে, রব্বে কারীমের তাওফিকে "শরীয়তের দৃষ্টিতে প্রচলিত ঈদে-মিলাদুন্নবী উদযাপন" শীর্ষক বিষয়ে কিঞ্চিত আলোকপাত করার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ্ । প্রিয় উপস্থিতি!

 

মিলাদ এর আভিধানিক অর্থ হলো জন্মকাল, জন্ম তারিখ । পরিভাষায় মিলাদ বা মিলাদুন্নবী বলা হয়-রাসূল (সা:) এর জন্ম বৃত্তান্ত নিয়ে আলোচনা এবং তার জন্মদিনকে কেন্দ্র করে কোন বিশেষ আয়োজনের মাধ্যমে জন্মদিন উদযাপন করা। ইতিহাসের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় ৬ষ্ঠ শতাব্দী পর্যন্ত কোন সাহাবী, তাবেয়ী, তাবে-তাবেয়ীন, মুহাদ্দিসীন কিংবা কোন ফকীহ ও বুযুর্গ এই মিলাদের প্রচলন করেননি বরং ইরাকের মুসিল শহরের অপচয়ী ও ধর্মীয় ব্যাপারে উদাসীন বাদশাহ মুজাফফরুদ্দীন কুকরী ইবনে ইরবিল এর নির্দেশে সর্বপ্রথম ৬০৪ হিজরীতে প্রচলিত এই মিলাদের সূচনা করা হয়। এবং এ ব্যাপারে মিলাদের দলীলাদি সম্বলিত কিতাব রচনা করে বাদশাহকে সহযোগিতা করেন দুনিয়ালোভি মৌলভি আবুল খাত্তাব উমার ইবনে হাসান ইবনে দেহ্‌ইয়া। সর্বশেষ গত শতাব্দীর শুরুর দিকে অখণ্ড ভারতের পাকিস্তানে অশুদ্ধ ইসলাম চর্চাকারী নির্দিষ্ট একটি মহল সর্বপ্রথম ১২ই রবিউল আওয়ালকে কেন্দ্র করে ঈদে মিলাদুন্নবী (সা:) এর নাম করে র‍্যালি বের করে। যা পরবর্তীতে আরো বর্ধিতরূপে প্রতিবছর পালন করা হয় ।

 

প্রিয় উপস্থিতি!

১২ই রবিউল আওয়ালকে কেন্দ্র করে এই দিনে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে আতশবাজি আর মিষ্টি ছোড়াছুড়ির আয়োজন করা হয়। এদিনে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর জন্ম হয়েছিল কিনা এ নিয়ে উলামায়ে কেরামের মধ্যে বিশাল মতবিরোধ রয়েছে । পক্ষান্তরে এদিনে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর ইন্তিকালের ব্যাপারে সামান্যতম মতবিরোধ নেই। কাজেই সুস্থ বিবেকসম্পন্ন প্রকৃত ঈমানদাররা কোনদিন নবীজির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে হাসি-তামাশা, গান- বাজনা আর আনন্দ র‍্যালির মত নিকৃষ্টতম উৎসব করতে পারে না। কিন্তু সুবিধাবাদী নামধারী এ সকল ভণ্ড প্রতারক আর সিন্নি খোররা নবীর ইন্তে কালের শোক আর দুঃখের পরিবর্তে জন্মদিনের আনন্দকেই গ্রহণ করেছে।

 

প্রিয় উপস্থিতি!

ইসলামের সাতশত বছরের সমৃদ্ধ ইতিহাসে ঈদে মিলাদুন্নবীর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। সাতশত বছর পর উদ্ভাবিত এই মিলাদ মাহফিল আর তেরশ বছর পর ঈদে মিলাদুন্নবী ইসলামের সাথে গাদ্দারী ছাড়া আর কিছুই নয় । ইসলামের নামে এসব নব আবিষ্কৃত উদ্ভট দিবস পালন প্রিয় নবীর রক্তে রঞ্জিত দ্বীনে ইসলামের পিঠে ছুরিকাঘাত করার নামান্তর। কেননা বিদায় হজ্জ্বের ভাষণে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে কুরআনের আয়াত উচ্চারণ করেছেন—

 

الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا অর্থাৎ, আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার নেয়ামত সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য দ্বীন হিসেবে পছন্দ করলাম। (সূরা আল-মায়েদা আয়াত-৩)

 

প্রিয় উপস্থিতি।

শরিয়তের দৃষ্টিতে জশনে জুলুস আর ঈদে মিলাদুন্নবী স্পষ্ট বেদআত । কেননা বেদআত বলা হয়-

لمْ يَكُنْ لَهَا ثُبُوْتٌ فِي خَيْرِ الْقُرُونِ

অর্থাৎ, খাইরুল কুরুনে যা সওয়াবের কাজ ও দ্বীনের কাজ হিসেবে প্রমাণিত নয় । অন্যদিকে নবী কারীম (সা:) ইরশাদ করেছেন- كُل مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلُّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ وَكُلُّ ضَلَالَةٍ فِي النَّارِ

 

অর্থাৎ, প্রত্যেক নবউদ্ভাবিত কাজই বিদআত আর প্রত্যেক বিদআত গোমরাহী, আর প্রত্যেক গোমরাহী জাহান্নামী।

 

সুপ্রিয় উপস্থিতি!

সাতশত বছর পর সাহাবী, তাবেয়ী তাবে-তাবেয়ী তথা খাইরুল কুরুনের যুগ পেরিয়ে ইসলামের নামে সৃষ্ট তথাকথিত এ মীলাদুন্নবী শরয়ী নুসূসের মাধ্যমে বেদআত হিসেবে সাব্যস্ত। বেদআতের ভয়াবহতা এমনই যে নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইরশাদ করেছেন-

مَنْ وَقَرَ صَاحِبَ بِدْعَةٍ فَقَدْ أَعَانَ عَلَى هَدَمِ الْإِسْلَامِ অর্থাৎ, যে ব্যক্তি বেদআতীকে সম্মান করল সে ইসলাম ধ্বংসের জন্য সাহায্য করল । সুতরাং স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই শরীয়তে মোহাম্মাদীর মধ্যে ঈদে মিলাদুন্নবীর কোন স্থান নেই। এটা মনগড়া কুসংস্কার আর বেদআত ছাড়া কিছুই না ।

 

প্রিয় উপস্থিতি!

প্রচলিত ঈদে মিলাদুন্নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) উদযাপন আজ আমাদের সমাজকে নিয়ে যাচ্ছে জাহিলী সমাজের দিকে। দিনক্ষণ, মাস ও বছরের বিশেষ দিনে ইসলামকে সীমাবদ্ধ করার ষড়যন্ত্র চলছে। শুধু তাই নয়, বর্তমানে ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপনের শোভাযাত্রা ও আনন্দ র‍্যালিতে ঢাক-ঢোল পিটাচ্ছে অথচ হাদীসে এরশাদ হচ্ছে-

الْجَرْسُ مَزامِيرُ الشَّيَاطِينِ

অর্থাৎ, ঘণ্টা, বাদ্যযন্ত্র হচ্ছে শয়তানের রশি । (যাদুত ত্বালেবীন : ৪)

 

প্রিয় উপস্থিতি!

ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপন উপলক্ষ্যে কথিত আশেকে রাসূলরা মহিলা-পুরুষ একত্রিত হয়ে অসংখ্য শরীয়ত বিরোধী কাজে লিপ্ত হচ্ছে। প্রতিটি কাজ-কর্মে নাজায়েযের ছড়াছড়ি, হালাল-হারামের কোন তোয়াক্কা নেই । নারী-পুরুষ একসাথে ডলাডলী করছে । নিজেদের মনগড়া দরুদে কাঁপিয়ে তুলছে খোদার জমীন । পর্দার বিধানকে বৃদ্ধাঙ্গুলী প্রদর্শন করছে । অথচ কুরআনে বলা হয়েছে- best of the ) অর্থাৎ, তারা যেন (স্বামী এবং এ ধরনের মাহরাম ব্যতিত) অন্য কারো কাছে তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে। (সূরা নূর, আয়াত : ৩১)

 

নবী প্রেমী বন্ধুরা আমার!

শুধু এখানেই শেষ নয়, মিলাদুন্নবী উদযাপনের নামে মাইজভাণ্ডারী, আটরশী, চন্দ্রপাড়া, কুতুববাগী, দেওয়ানবাগী, রাজারবাগীর মত দেশ, সমাজ ও ইসলামের শত্রুরা এদেশের হক্কানী আলেম উলামাকে সমাজের মানুষের সামনে হেয় প্রতিপন্ন করে ওহাবী সুন্নি ফতোয়া দিয়ে বেড়ায় । এমনকি রাতের অন্ধকারে প্রকৃত আশেকে রাসূলদের হত্যাকারীরা মিলাদুন্নবী উপলক্ষে নবীর গুণগ্রাহী সেজে বিশাল বিশাল বাণী ছাড়ে।

 

প্রিয় সংগ্রামী সাথী ও বন্ধুগণ!

বছরের পর বছর গেল, নবীর রক্তে মাখা দ্বীন নিশ্চিহ্ন হতে চলল। এ দেশের নাস্তিক মুরতাদরা নিষ্পাপ নবীর চরিত্রকে নির্মমভাবে ক্ষতবিক্ষত করল। শাপলার রক্ত কংক্রিটের রাস্তা নবী প্রেমীদের রক্তে লাল হয়ে গেল। বছরের প্রথম দিন অশ্লীলতা ও বেহায়াপনার মাধ্যমে উম্মতের দরদী নবীর আদর্শের বুকে আঘাত করা হলো। সেদিন কোথায় ছিল তোমাদের ভালোবাসার বাণী । কোথায় ছিল তোমাদের নবী প্রেম। তোমাদেরকে স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, শাপলার শহীদের রক্ত আজও শুকাইনি । নবী প্রেমিকদের বুকের তপ্ত আগুন আজও নিভে নাই । খোদার কসম নবী প্রেম নিয়ে যদি রাজনীতি করা হয়। এ দেশের লক্ষ কোটি নবী প্রেমিকদের বুকে আঘাত করা হয়। শাপলার শহীদের রক্ত নিয়ে উপহাস করা হয়। তাহলে এদেশের আলেম সমাজ বসে থাকবে না। প্রয়োজনে জীবন দিবে। তবুও মিলাদুন্নবীর নামে নবীজি (সা:) এর ভালোবাসা নিয়ে উপহাস বরদাশত করা হবে না ।

 

পরিশেষে নবী প্রেমে উদ্ভাসিত যুবকদেরকে বলতে চাই!

ওহে মুহাম্মদী আদর্শের যুবক বন্ধুরা! তোমাদের নতুন করে তৈরি হতে হবে। সীরাত চর্চার মাধ্যমে শিক্ষাগ্রহণ করতে হবে। সপ্তাহের প্রতি সোমবার রোযা রাখার অভ্যাস করতে হবে। খোদার রাহে জীবনকে বিলিয়ে দেয়ার শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। মিলাদুন্নবীর জবাব সীরাত মাহফিলের মধ্য দিয়ে দিতে হবে। টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া, রূপসা থেকে পাথুরিয়া সীরাত মাহফিলের আয়োজন করতে হবে । নবীজির সীরাত শিক্ষা বাংলার ৫৬ হাজার বর্গমাইল জুড়ে ছড়িয়ে দিতে হবে । মিষ্টি-জিলাপি খাওয়ার আশেকে রাসূল নয়, দেহের প্রতি ফোটা রক্ত আর হৃৎপিণ্ড বের করে দেয়ার প্রকৃত আশেকে রাসূল এর ইশতিহার গ্রহণ করতে হবে। তাহলেই এ দেশ ও জাতি বেদআত ও কুসংস্কার থেকে মুক্তি পাবে । স্বার্থক হবে আজকের আয়োজন ।

 

نَصْرٌ مِّنَ اللَّهِ وَفَتْحٌ قَرِيبٌ

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url