কুরবানি বিষয়ক প্রবন্ধ

 কুরবানী ইসলামের শিআর। আল্লাহ তাআলার কুরব তথা নৈকট্য অর্জনের এক বিশেষ বিধান। কুরবানী মিল্লাতে ইবরাহীমীর সাথে উম্মতে মুসলিমার এক মেলবন্ধন। এতে আছে রাব্বুল আলামীনের আদেশের সামনে সমর্পিত হওয়ার মহা দীক্ষা। কুরবানীর প্রচলন পৃথিবীর শুরু থেকেই। ইতিহাসের প্রথম কুরবানী তো সুপ্রসিদ্ধ। আদিপিতা আদম আ.-এর দুই পুত্রের কুরবানী। কুরআন মাজীদে যার বিবরণ এসেছে এভাবে-

وَ اتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَاَ ابْنَيْ اٰدَمَ بِالْحَقِّ  اِذْ قَرَّبَا قُرْبَانًا فَتُقُبِّلَ مِنْ اَحَدِهِمَا وَ لَمْ يُتَقَبَّلْ مِنَ الْاٰخَرِ  قَالَ لَاَقْتُلَنَّكَ قَالَ اِنَّمَا يَتَقَبَّلُ اللهُ مِنَ الْمُتَّقِيْنَ.

আপনি তাদেরকে আদমের দুই পুত্রের কাহিনীটি শুনিয়ে দিন। যখন তারা দুজনে কুরবানী করল এবং একজনের কুরবানী কবুল হল আর অন্যজনেরটি কবুল হল না। তখন সে বললআমি তোমাকে হত্যা করব। অপরজন বললআল্লাহ তো মুত্তাকীদেরই কুরবানী কবুল করেন। -সূরা মায়েদা (৫) : ২৭

পরবর্তীতে যুগ ও জাতির বিভিন্নতায় কুরবানীর বিধান ও পদ্ধতিতেও আসে ভিন্নতা। তবে উম্মতে মুসলিমা তথা শ্রেষ্ঠ নবী এবং শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উম্মতের জন্য কুরবানীর বিধানটি মুসলিম জাতির পিতা ইবরাহীম আ. কর্তৃক নিজ পুত্র ইসমাঈলকে কুরবানী করার মহিমান্বিত দাস্তানের সাথে যুক্ত। যার বর্ণনা কুরআন মাজীদে এভাবে এসেছে-

فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ السَّعْيَ قَالَ يٰبُنَيَّ اِنِّيْۤ اَرٰي فِي الْمَنَامِ اَنِّيْۤ اَذْبَحُكَ فَانْظُرْ مَا ذَا تَرٰي قَالَ يٰۤاَبَتِ افْعَلْ مَا تُؤْمَرُ سَتَجِدُنِيْۤ اِنْ شَآءَ اللهُ مِنَ الصّٰبِرِيْنَ، فَلَمَّاۤ اَسْلَمَا وَ تَلَّهٗ لِلْجَبِيْنِ، وَ نَادَيْنٰهُ اَنْ يّٰۤاِبْرٰهِيْمُ، قَدْ صَدَّقْتَ الرُّءْيَا اِنَّا كَذٰلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِيْنَ، اِنَّ هٰذَا لَهُوَ الْبَلٰٓؤُا الْمُبِيْنُ، وَ فَدَيْنٰهُ بِذِبْحٍ عَظِيْمٍ، وَ تَرَكْنَا عَلَيْهِ فِي الْاٰخِرِيْنَ، سَلٰمٌ عَلٰۤي اِبْرٰهِيْمَ، كَذٰلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِيْنَ، اِنَّهٗ مِنْ عِبَادِنَا الْمُؤْمِنِيْنَ.

অনন্তর যখন পুত্রটি তাঁর সাথে চলাফেরা করার মতো বয়সে উপনীত হলতখন তিনি বললেনবৎস! আমি স্বপ্নে দেখেছি যেতোমাকে যবেহ করছি। অতএব তুমিও চিন্তা করতোমার কী মত। তিনি বললেনআব্বাজান! আপনি যে বিষয়ে আদিষ্ট হয়েছেন তা পূর্ণ করুন। ইনশাআল্লাহ আমাকে ধৈর্যশীলদের অন্তভুর্ক্ত পাবেন।

ফলকথাযখন তাঁরা আত্মসমর্পণ করলেন এবং পিতা পুত্রকে কাত করে শায়িত করলেন এবং আমি তাঁকে ডেকে বললামহে ইবরাহীম! নিশ্চয়ই আপনি স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখিয়েছেন। আমি বিশিষ্ট বান্দাদেরকে এরূপই পুরস্কার প্রদান করে থাকি। প্রকৃতপক্ষেও তা ছিল একটি বড় পরীক্ষা। আর আমি তার পরিবর্তে একটি শ্রেষ্ঠ যবেহের পশু দান করলাম। এবং আমি তাঁর জন্য পশ্চাতে আগমনকারীদের মধ্যে এই বাক্য থাকতে দিলাম যেইবরাহীমের প্রতি সালাম হোক। আমি বিশিষ্ট বান্দাদেরকে এরূপই পুরস্কার প্রদান করে থাকি। নিঃসন্দেহে তিনি আমার ঈমানদার বান্দাগণের অন্যতম ছিলেন। -সূরা সাফফাত (৩৭) : ১০২-১১১

পিতা-পুত্রের এই ত্যাগ ও আত্মত্যাগ আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে এত পছন্দনীয় হল যেতিনি কিয়ামত পর্যন্ত আগত উম্মতের জন্য তা বিধিবদ্ধ করে দিলেন।

নিম্নে কুরবানী সম্পর্কিত কিছু হাদীস ও আছার উল্লেখ করা হল।

কুরবানীর বিধান

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন-

فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ.

সুতরাং আপনার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় করুন এবং কুরবানী করুন। -সূরা কাওসার (১০৮) : ২

তাফসীরবিদগণ বলেনএ আয়াতে নাহর দ্বারা উদ্দেশ্য হল ঈদের নামায-পরবর্তী কুরবানী।

ইমাম কুরতুবী রাহ. বলেনفَصَلِّ -এর একটি তাফসীর এ-ও যেআপনার রবের উদ্দেশ্যে ঈদের সালাত আদায় করুন। তিনজন তাবেয়ী ইমামকাতাদাহ রাহ.আতা রাহ. ও ইকরিমা রাহ. বলেনআপনার রবের উদ্দেশ্যে নাহরের (কুরবানী) দিনে ঈদের নামায আদায় করুন।

وَانْحَرْ অর্থাৎ আপনার কুরবানীর পশু যবাই করুন। -তাফসীরে কুরতুবী ২০/১৪৮

অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-

قُلْ اِنَّ صَلَاتِيْ وَ نُسُكِيْ وَ مَحْيَايَ وَ مَمَاتِيْ لِلهِ رَبِّ الْعٰلَمِيْنَ، لَا شَرِيْكَ لَهٗ وَ بِذٰلِكَ اُمِرْتُ وَ اَنَا اَوَّلُ الْمُسْلِمِيْنَ.

আপনি বলুননিশ্চয়ই আমার নামাযআমার ইবাদত (কুরবানী) ও আমার জীবন-মরণ সবই আল্লাহর জন্যযিনি জগৎসমূহের প্রতিপালক। তাঁর কোনো শরীক নেই। আর আমি এরই আদিষ্ট হয়েছি এবং আমিই প্রথম মুসলমান। -সূরা আনআম (৬) : ১৬২-১৬৩

উপরোক্ত প্রথম আয়াতে وَانْحَرْ শব্দটি আদেশসূচক পদ। উসূলে ফিকহের একটি স্বতঃসিদ্ধ মূলনীতি হলআদেশসূচক শব্দ ওয়াজিব তথা আবশ্যকীয় বোঝায়।

আর দ্বিতীয় আয়াতে আছেوَ بِذٰلِكَ اُمِرْتُ (আর আমি এ বিষয়ে আদিষ্ট হয়েছি।)

বলাবাহুল্য যেআল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যার আদিষ্ট হয়েছেন তা উম্মতে মুহাম্মদীর জন্যও ওয়াজিব। যদি আদেশটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে বিশিষ্ট হওয়ার কোনো দলীল না থাকে।

সুতরাং উপরোক্ত আয়াতদুটি থেকে কুরবানীর বিধান ওয়াজিব তথা আবশ্যক হওয়া প্রমাণিত হয়।

আর হাদীস শরীফেও কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার প্রমাণ রয়েছে। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিতরাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

من قدر على سعة فلم يضح فلا يقربن مصلانا.

কুরবানী করার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি কুরবানী করল নাসে যেন আমাদের ঈদগাহের কাছেও না আসে। -সুনানে ইবনে মাজাহহাদীস ৩১২৩মুসনাদে আহমাদহাদীস ৮২৫৬

مسند أحمد، تحقيق : أحمد شاكر  ١٦‏/١٢٠ : إسناده حسن، وأخرجه ابن ماجه (٢١٢٣)، وأحمد (٨٢৫৬واللفظ له.

আবু হুরায়রা রা. থেকে অন্য বর্ণনায় এসেছেআল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

من كان عنده سعة فليضح، فمن لم يضح فلا يقربن مسجدنا.

কারো সামর্থ্য থাকলে সে যেন কুরবানী করে। এর পরও কেউ কুরবানী না করলে সে যেন আমাদের মসজিদের কাছেও না আসে। -সুনানে ইবনে মাজাহহাদীস ৩১৬০আসসুনানুল কুবরাবায়হাকী ৯/২৬০

উভয় রেওয়ায়েত সম্পর্কে মুহাদ্দিসগণের একটি মত এ-ও রয়েছে যেএটি মারফূ  হাদীস নয়মূলত সাহাবী আবু হুরায়রা রা.-এর বক্তব্য। পরবর্তী বর্ণনাকারী ভুলবশত এটিকে মারফূ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু মনে রাখতে হবেসাহাবীর ফতওয়াও শরীয়তে দলীলের মান রাখে।

مع احتمال قوي أن يكون مرفوعا حكميا.

যাইহোকএই রেওয়ায়েতে বলা হয়েছেকেউ যদি কুরবানী না করে তাহলে সে যেন আমাদের ঈদগাহের কাছেও না আসে। এর বাহ্যিক অর্থ দ্বারাও কুরবানী আবশ্যক হওয়া প্রতীয়মান হয়। কেননাএর দ্বারা ঈদগাহে উপস্থিত হওয়া ও নামায পড়তে নিষেধ করা উদ্দেশ্য নয়। -শরহু মুখতাসারিত তহাবী ৭/৩১১

قال الطحاوي في مختصره :/৩১১ : والثاني : قوله : فمن لم يضح فلا يقربن مصلانا، والمعقول من ظاهر هذا اللفظ الوجوب، لأنه معلوم أنه لم يرد به نهيه عن الصلاة، وحضور المسجد، وإنما المراد والله أعلم : على غير سبيلنا، وبمنزلة من خالف سنتنا، أو ما جرى مجرى ذلك.

মিখনাফ ইবনে সুলাইম রা. বলেন-

كُنّا وُقُوفًا مَعَ النّبِيِّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ بِعَرَفَاتٍ، فَسَمِعْتُهُ يَقُولُيَا أَيّهَا النّاسُ، عَلَى كُلِّ أَهْلِ بَيْتٍ فِي كُلِّ عَامٍ أُضْحِيّةٌ.

আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে আরাফায় অবস্থান করছিলাম। তখন তাঁকে বলতে শুনেছিহে লোকসকল! প্রত্যেক ঘরওয়ালার উপর প্রতি বছর কুরবানী আবশ্যক। -জামে তিরমিযীহাদীস ১৫১৮সুনানে আবু দাউদহাদীস ২৭৮৮মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবাহাদীস ২৪৭৮৬

তাছাড়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি বছর কুরবানী করেছেন। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. বলেন-

أَقَامَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ بِالمَدِينَةِ عَشْرَ سِنِينَ يُضَحِّي كُلّ سَنَةٍ.

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় দশ বছর ছিলেন। প্রতি বছরই কুরবানী করেছেন। -জামে তিরমিযীহাদীস ১৫০৭মুসনাদে আহমাদহাদীস ৪৯৫৫

এই হাদীসে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিয়মিত কুরবানী করার কথা আছে। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কোনো কাজ নিয়মিত করাই কাজটির ওয়াজিব হওয়ার প্রমাণ। -তাকমিলা ফাতহুল মুলহিম ৩/৫৪৯

উপরোক্ত আয়াত ও হাদীসের আলোকে ইমাম আবু হানীফা রাহ. বলেনসামর্থ্যবান ব্যক্তির উপর কুরবানী করা ওয়াজিব।

ইমাম রাবীয়াহ রাহ.আওযায়ী রাহ.লাইস ইবনে সাদ রাহ.ছাওরী রাহ.নাখায়ী রাহ. প্রমুখের অভিমতও অনুরূপ।

ইমাম মালেক রাহ.-এরও একটি মত এরূপ। তাছাড়া মুজাহিদ রাহ.মাকহূল রাহ. ও শাবী রাহ. প্রমুখ থেকেও এমনটি বর্ণিত আছে। -শরহু মুখতাসারিত তহাবী ৭/৩০৭আলমুগনীইবনে কুদামা ১৩/৩৬০ফাতাওয়া তাতারখানিয়া ১৭/৪০৩তাকমিলা ফাতহুল মুলহিম ৩/৫৪৮

সারকথাকুরবানী ইসলামের শিআর এবং জরুরি ইবাদত। এতে ইমামদের মাঝে কোনো দ্বিমত নেই। ইখতিলাফ শুধু এতটুকু যেঅনেক ইমাম একে ওয়াজিব বলেন। আর আমাদের নিকট এই বক্তব্যের দলীলই শক্তিশালী। আর ইমাম শাফেয়ী রাহ.-সহ অনেক ফকীহ একে সুন্নত বলেন। তবে সুন্নত দ্বারা তাদের অনেকের উদ্দেশ্য সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ। আর সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ জরুরি আমলেরই অন্তর্ভুক্ত।

উল্লেখ্যআজকাল কাউকে দেখা যায়তারা কুরবানী সুন্নত বা মুস্তাহাব হওয়ার বক্তব্য ঢালাওভাবে প্রচার করতে থাকেন। এই আমলটি যে ইসলামের শিআর এবং জরুরি ইবাদততা তারা এড়িয়ে যান। এটি সংশোধনযোগ্য।

নিম্নে আমরা কুরবানীর কিছু জরুরি মাসআলা পেশ করার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ।

মাসআলা : কুরবানীর দিনগুলোতে (১০ যিলহজ্ব ফজর উদয়ের পর থেকে ১২ যিলহজ্ব সূর্যাস্ত পর্যন্ত) কেউ প্রয়োজনের অতিরিক্ত নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে তার উপর কুরবানী করা ওয়াজিব।

গায়রুল্লাহর নামে যবাইকারীর প্রতি অভিসম্পাত

আবুত তুফায়েল রা. বলেনআমরা আলী ইবনে আবী তালিব রা.-এর নিকট আরয করলামআপনার কাছে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর গুপ্ত রাখা কোনো বিষয় সম্পর্কে অবহিত করুন। তিনি বললেনআল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষের কাছ থেকে লুকিয়ে কোনো কিছু আমার কাছে গুপ্ত রাখেননি। তবে আমি তাঁকে বলতে শুনেছি-

لعن الله من ذبح لغير الله، ولعن الله من آوى محدثا، ولعن الله من لعن والديه، ولعن الله من غير المنار.

আল্লাহ তাআলা অভিসম্পাত করেন গায়রুল্লাহর নামে যবাইকারীর প্রতি। তিনি অভিসম্পাত করেন  মুহদিসকে (বিশৃঙ্খলা ও অনর্থ সৃষ্টিকারী) প্রশ্রয়দানকারীর প্রতিপিতামাতাকে অভিসম্পাতকারীর প্রতি এবং জমির সীমানা-চিহ্ন পরিবর্তনকারীর প্রতি। -সহীহ মুসলিমহাদীস ১৯৭৮মুসনাদে আহমাদহাদীস ৮৫৫৯৫৪শরহু মুসলিমনববী ২/১৬০১/৪৪১

আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিতরাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

مَلْعُونٌ مَنْ سَبَّ أَبَاهُ، مَلْعُونٌ مَنْ سَبَّ أُمَّهُ، مَلْعُونٌ مَنْ ذَبَحَ لِغَيْرِ اللهِ، مَلْعُونٌ مَنْ غَيَّرَ تُخُومَ الْأَرْضِ، مَلْعُونٌ مَنْ كَمَّهَ أَعْمَى عَنِ الطَّرِيقِ، مَلْعُونٌ مَنْ وَقَعَ عَلَى بَهِيمَةٍ، مَلْعُونٌ مَنْ عَمِلَ عَمَلَ قَوْمِ لُوطٍ.

যে পিতাকে গালি দেয় সে অভিশপ্তযে মাকে গালি দেয় সে অভিশপ্ত। গায়রুল্লাহর নামে যবাইকারী অভিশপ্ত। জমির সীমানা-চিহ্ন পরিবর্তনকারী অভিশপ্ত। অন্ধকে ভুল পথ নির্দেশকারী অভিশপ্ত। চতুষ্পদ প্রাণীর সাথে সঙ্গমকারী অভিশপ্ত। আর যে লূত সম্প্রদায়ের মতো কাজ করে সে অভিশপ্ত। -মুসনাদে আহমাদহাদীস ১৮৭৫

আরও দেখুন : সহীহ ইবনে হিব্বানহাদীস ৪৪১৭

যে ব্যক্তি কুরবানীর ইচ্ছা করবে সে যিলহজ্ব মাসের শুরু থেকে নখ ও চুল কাটবে না

উম্মুল মুমিনীন উম্মে সালামা রা. বলেনআল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

مَن رأى منكم هِلالَ ذي الحِجَّةِ فأراد أن يُضَحِّيَ فلا يأخُذْ من شعرِه وأظفارِه حتى يُضَحِّيَ.

যিলহজ্বের চাঁদ দৃষ্টিগোচর হওয়ার পর তোমাদের মধ্যে যে কুরবানীর ইচ্ছা রাখে সে যেন কুরবানী করা পর্যন্ত তার নখচুল ইত্যাদি না কাটে। -সহীহ মুসলিমহাদীস ১৯৭৭জামে তিরমিযীহাদীস ১৫২৩

ওলীদ ইবনে মুসলিম বলেনআমি মুহাম্মাদ বিন আজলানকে যিলহজ্বের দশকে চুল কাটা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেনআমাকে নাফে রাহ. বলেছেন-

إن ابن عمر مر بامرأة تأخذ من شعر ابنها في الأيام العشر، فقال : لو أخرتيه إلى يوم النحر كان أحسن.

আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. এক নারীর পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলেন। যিনি যিলহজ্বের দশকের ভেতর তার সন্তানের চুল কেটে দিচ্ছিলেন। তখন তিনি বললেনযদি ঈদের দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে তবে বড় ভালো হত। -মুস্তাদরাকে হাকেমহাদীস ৭৫৯৫

অন্য বর্ণনায় মুতামির ইবনে সুলাইমান আততাইমী রাহ. বলেনআমি আমার পিতাকে বলতে শুনেছি-

كان ابن سيرين يكره إذا دخل العشر أن يأخذ الرجل من شعره حتى يكره أن يحلق الصبيان في العشر.

ইবনে সীরীন রাহ. যিলহজ্বের দশকে চুল কাটা অপছন্দ করতেন। এমনকি এই দিনগুলোতে বাচ্চাদের মাথা মুণ্ডণ করাও অপছন্দ করতেন। -আল মুহাল্লাইবনে হাযম ৬/২৮

মাসআলা : যিলহজ্বের চাঁদ দেখার পর থেকে কুরবানীর আগ পর্যন্ত নিজের নখচুলমোচনাভীর নিচের পশম ইত্যাদি না কাটা। এটা মুস্তাহাব আমল।

আর যে ব্যক্তি কুরবানী করতে সক্ষম নয় সেও এ আমল করবে। অর্থাৎ নিজের চুলনখগোঁফ ইত্যাদি কাটবে নাবরং তা কুরবানীর দিন কাটবে।

আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা. বলেনরাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

أمرت بيوم الأضحى جعله الله عيدا لهذه الأمةقال له رجليا رسول اللهأرأيت إن لم أجد إلا منيحة أنثى أفأضحي بها؟ قال : لا، ولكن خذ من شعرك وأظفارك وتقص شاربك وتحلق عانتك، فذلك تمام أضحيتك.

আমি কুরবানীর দিন সম্পর্কে আদিষ্ট হয়েছি (অর্থাৎ এ দিবসে কুরবানী করার আদেশ করা হয়েছে।) আল্লাহ তাআলা এ উম্মতের জন্য তা ঈদ হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। এক ব্যক্তি আরজ করলইয়া রাসূলাল্লাহ! যদি আমার কাছে শুধু একটি মানীহা থাকে অর্থাৎ যা শুধু দুধপানের জন্য দেওয়া হয়েছে?

আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেননাবরং সেদিন তুমি তোমার চুল কাটবে (মুণ্ডাবে বা ছোট করবে)নখ কাটবেমোচ এবং নাভীর নিচের পশম পরিষ্কার করবে। এটাই আল্লাহর কাছে তোমার পূর্ণ কুরবানী বলে গণ্য হবে। -মুসনাদে আহমাদহাদীস ৬৫৭৫সুনানে আবু দাউদহাদীস ২৭৮৯সুনানে নাসায়ীহাদীস ৪৩৬৫

যবাইয়ের সময় বিসমিল্লাহ আল্লাহু আকবার বলা

আনাস ইবনে মালেক রা. বর্ণনা করেন-

كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُضَحِّي بِكَبْشَيْنِ أَقْرَنَيْنِ أَمْلَحَيْنِ، وَكَانَ يُسَمِّي وَيُكَبِّرُ، وَلَقَدْ رَأَيْتُهُ يَذْبَحُهُمَا بِيَدِهِ وَاضِعًا عَلَى صِفَاحِهِمَا قَدَمَهُ.

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বড় শিংবিশিষ্ট সাদা-কালো বর্ণের দুটি নর দুম্বা কুরবানী করতেন এবং তিনি বিসমিল্লাহআল্লাহু আকবার বলতেন।

বর্ণনাকারী আরও বলেনআমি তাঁকে পশুর ঘাড়ের ডানপাশে পা রেখে নিজ হাতে যবাই করতে দেখেছি। -মুসনাদে আহমাদহাদীস ১১৯৬০১২১৪৭

আনাস ইবনে মালেক রা. থেকে অন্য বর্ণনায় আছে-

أَنَّهُ رَأَى النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ذَبَحَ أُضْحِيَّتَهُ بِيَدِهِ، وَكَانَ يُكَبِّرُ عَلَيْهَا.

অর্থাৎ তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তাকবীর বলতে বলতে নিজ হাতে কুরবানীর পশু যবাই করতে দেখেছেন। -মুসনাদে আহমাদহাদীস ১২৪৬৬

তিনি আরও বলেন-

أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ذَبَحَ، فَسَمَّى وَكَبَّرَ.

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিসমিল্লাহ ও আল্লাহু আকবার বললেন অতঃপর যবাই করলেন। -মুসনাদে আহমাদহাদীস ১২৮৯৩

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কুরবানী

জাবের ইবনে আবদুল্লাহ রা. বলেননবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানীর দিন বড় শিংবিশিষ্ট ও সাদা কালো বর্ণের দুটি নর দুম্বা যবাই করেছেন। যখন যবাইয়ের জন্য শোয়ালেনতখন বললেন-

إِنِّي وَجَّهْتُ وَجْهِيَ لِلَّذِيْ فَطَرَ السَّمَوَاتِ وَالْأَرْضَ، حَنِيْفًا مُسْلِمًا، وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِينَ، إِنَّ صَلَاتِيْ، وَنُسُكِيْ، وَمَحْيَايَ، وَمَمَاتِي لِلهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ، لَا شَرِيْكَ لَهُ، وَبِذلِكَ أُمِرْتُ، وَأَنَا أَوَّلُ الْمُسْلِمِيْنَ، بِسْمِ اللهِ، واللهُ أَكْبَرُ، اللهُمَّ مِنْكَ، وَلَكَ عَنْ مُحَمَّدٍ، وَأُمَّتِهِ.

এরপর বিসমিল্লাহআল্লাহু আকবার বলে যবাই করলেন। -মুসনাদে আহমাদহাদীস ১৫০২২সুনানে আবু দাউদহাদীস ৩৮৬সুনানে ইবনে মাজাহহাদীস ২২৫

পূর্বে আনাস ইবনে মালেক রা.-এর একটি বর্ণনা উল্লেখ করা হয়েছেআল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বড় শিংবিশিষ্ট সাদা-কালো বর্ণের দুটি নর দুম্বা কুরবানী করতেন এবং তিনি বিসমিল্লাহআল্লাহু আকবার বলতেন। -মুসনাদে আহমাদহাদীস ১১৯৬০১২১৪৭

এছাড়াও সামনে উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা.-এর একটি বর্ণনা আসছে। যাতে উল্লেখ করা হয়েছে যেআল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানী করার জন্য বড় শিং এবং দুই পাহাঁটু ও চোখের আশপাশে শুভ্রতাবিশিষ্ট একটি দুম্বা সংগ্রহের আদেশ করলেন। অতঃপর তা আনা হলে তিনি আমাকে বললেনহে আয়েশা! ছুরি নিয়ে এস। অতঃপর বললেনপাথর দিয়ে তা ধার দাও। আমি তা করলাম। অতঃপর তিনি তা নিলেন এবং দুম্বাটিকে ধরে শোয়ালেন। এরপর-

باسْمِ اللهِ، اللّهُمَّ تَقَبَّلْ مِن مُحَمَّدٍ، وآلِ مُحَمَّدٍ، ومِن أُمَّةِ مُحَمَّدٍ .

-বলতে বলতে তা যবাই করলেন। -সহীহ মুসলিমহাদীস ১৯৬৭সুনানে আবু দাউদহাদীস ২৭৯২

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকে কুরবানী করা

আলী রা. প্রতি বছর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকে কুরবানী করতেন।

আলী ইবনে আবী তালিব রা. বলেন-

أمرَني رَسولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أن أُضحِّيَ عنهُ، فأَنا أضحِّي عنهُ أبدًا.

আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে তাঁর পক্ষ থেকে কুরবানী করার ওসিয়ত করেছেন। তাই আমি সবসময় তাঁর পক্ষ থেকে কুরবানী করি।  -মুসনাদে আহমাদহাদীস ১৩৭৭

অন্য বর্ণনায় হানাশ রাহ. বলেনআমি আলী রা.-কে দুটি দুম্বা কুরবানী করতে দেখলাম। তখন জিজ্ঞাসা করলামদুটি কেনতিনি বললেন-

إِنّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم أَوْصَانِي أَنْ أُضَحِّيَ عَنْهُ فَأَنَا أُضَحِّي عَنْهُ.

আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে তাঁর পক্ষ থেকে কুরবানী করার ওসিয়ত করেছেন। তাই আমি তাঁর পক্ষ থেকেও কুরবানী করি। -সুনানে আবু দাউদহাদীস ২৭৯০জামে তিরমিযীহাদীস ১৪৯৫মুসনাদে আহমাদহাদীস ১২৮৬

কুরবানীর পশুর বয়সসীমা

জাবের ইবনে আবদুল্লাহ রা. বলেনআল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

لَا تَذْبَحُوا إِلّا مُسِنّةً، إِلّا أَنْ يَعْسُرَ عَلَيْكُمْ، فَتَذْبَحُوا جَذَعَةً مِنَ الضّأْنِ.

তোমরা কুরবানীতে মুছিন্না ছাড়া যবাই করো না। যদি তা পাওয়া দুষ্কর হয় তবে ৬ মাস বয়সের ভেড়া-দুম্বা যবাই করতে পার। -সহীহ মুসলিমহাদীস ১৯৬৩সুনানে আবু দাউদহাদীস ২৭৯৭সুনানে ইবনে মাজাহহাদীস ৩১৭৯

ইমাম নববী রাহ. বলেনমুছিন্না হল৫ বছর বয়সী উট২ বছরের গরুমহিষ এবং ১ বছর বয়সী ছাগলভেড়া বা দুম্বা। শরহুল মুসলিমইমাম নববী ২/১৫৫

আরও দেখুন : তাকমিলা ফাতহুল মুলহিম ৩/৫৫৮

মাসআলা : কুরবানীর জন্য উট কমপক্ষে ৫ বছর বয়সের হতে হবে। গরু ও মহিষ কমপক্ষে ২ বছরের। আর ছাগলভেড়া ও দুম্বা কমপক্ষে ১ বছরের হতে হবে। তবে ন্যূনতম ৬ মাস বা তার বেশি বয়সের কোনো ভেড়া বা দুম্বা যদি হৃষ্টপুষ্টতার কারণে ১ বছরের মতো মনে হয় তাহলে তা দ্বারাও কুরবানী করা জায়েয। ৬ মাসের কম হলে জায়েয হবে না।

উল্লেখ্যছাগলের বয়স ১ বছরের  কম হলে তা দ্বারা কোনো অবস্থাতেই কুরবানী করা জায়েয হবে না। -ফাতাওয়া খানিয়া ৩/৩৪৮বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৫-২০৬ 

কুরবানীর পশু হৃষ্টপুষ্ট হওয়া উত্তম

হাদীসে এসেছে-

أَنّ رَسُولَ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ ضَحّى بِكَبْشَيْنِ سَمِينَيْنِ عَظِيمَيْنِ أَمْلَحَيْنِ أَقْرَنَيْنِ مُوْجَيَيْنِ.

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুটি বড় শিংবিশিষ্ট সাদা-কালো বর্ণের হৃষ্টপুষ্ট নর দুম্বা যবাই করেছেন। -মুসনাদে আহমাদহাদীস ২৫০৪৬সুনানে ইবনে মাজাহহাদীস ৩১৫৯

যেসব পশু কুরবানী করা জায়েয নয়

বারা ইবনে আযেব রা. বলেনআমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি-

لَا يَجُوزُ مِنَ الضَّحَايَا أَرْبَعٌ : الْعَوْرَاءُ الْبَيِّنُ عَوَرُهَا، وَالْعَرْجَاءُ الْبَيِّنُ عَرَجُهَا، وَالْمَرِيضَةُ الْبَيِّنُ مَرَضُهَا، وَالْعَجْفَاءُ الَّتِي لَا تنقي.

চার প্রকারের পশু কুরবানী করা জায়েয নয়। যথা : পশুর উভয় বা কোনো এক চোখের দৃষ্টিহীনতা স্পষ্ট হলেকোনো এক পা খেঁাড়া হলেঅতি রুগ্ন হলে এবং এত শীর্ণ পশুযার অস্থিমজ্জা সারশূন্য হয়ে পড়েছে। -সহীহ ইবনে হিব্বানহাদীস ৫৯২১সুনানে আবু দাউদহাদীস ২৮০২সুনানে নাসায়ীহাদীস ৪৩৬৯সুনানে ইবনে মাজাহহাদীস ৩১৪৪

আলী ইবনে আবী তালেব রা. বলেন-

نهى رسولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أن يُضَحّى بالمُقابَلَةِ أو بمُدابَرَةٍ أو شَرْقاءَ أو خَرْقاءَ أو جَدْعاءَ.

আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কানের অগ্রভাগ কাটা প্রাণীকানের গোড়া থেকে কেটে ঝুলে আছে এমন প্রাণীকান ফেটে দ্বিখণ্ডিত হয়ে যাওয়া প্রাণীকানে গোল ছিদ্রবিশিষ্ট প্রাণী ও কান বা নাক একেবারে কেটে গেছেএমন প্রাণী কুরবানী করতে নিষেধ করেছেন। -সুনানে ইবনে মাজাহহাদীস ৩১৪২মুসনাদে আহমাদহাদীস ৬০৯

আরেক বর্ণনায় আলী রা. বলেন-

نهى رسول الله صلى الله عليه وسلم أن يضحي بعضباء القرن والأذن.

আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কান কিংবা শিংয়ের অর্ধেক বা তার বেশি ভেঙে গেছেএমন প্রাণী কুরবানী করতে নিষেধ করেছেন। -সুনানে আবু দাউদহাদীস ২৮০৫মুসনাদে আহমাদহাদীস ৬৩৩

আলী রা. আরও বলেন-

أمرنا رسول الله صلى الله عليه وسلم أن نستشرف العين والأذن.

আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে (হাদী ও কুরবানীর) প্রাণীর চোখ ও কান সুস্থ হওয়ার বিষয়টি বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখার আদেশ করেছেন। -জামে তিরমিযীহাদীস ১৫০৩সহীহ ইবনে হিব্বানহাদীস ৫৯২০সুনানে ইবনে মাজাহহাদীস ৩১৪৩মুসনাদে আহমাদহাদীস ৭৩২

অন্য বর্ণনায় আছেহুজাইয়া ইবনে আদী রাহ. বলেনজনৈক ব্যক্তি আলী রা.-কে কুরবানীর গরু সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেনসাতজনের পক্ষ থেকে।

তিনি জিজ্ঞাসা করলেনশিং ভাঙা হলে?

আলী রা. বললেনসমস্যা নেই।

জিজ্ঞাসা করলেনআরজা (খোঁড়া) হলে?

তিনি বললেনযবাইয়ের স্থান পর্যন্ত হেঁটে যেতে পারলে তা যবাই কর। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে (হাদী ও কুরবানীর) পশুর চোখ ও কান সুস্থ হওয়ার বিষয়টি বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখার আদেশ করেছেন। -মুসনাদে আহমাদহাদীস ৭৩৪

মাসআলা : এমন শুকনো ও দুর্বল পশুযা যবাইয়ের স্থান পর্যন্ত হেঁটে যেতে পারে না তা দ্বারা কুরবানী করা জায়েয নয়। -জামে তিরমিযী ১/২৭৫ফাতাওয়া হিন্দিয়া ৫/২৯৭বাদায়েউস সানায়ে ৪/২১৪

মাসআলা : যে পশুর শিং একেবারে গোড়া থেকে ভেঙে গেছেযার দরুন মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সে পশু কুরবানী করা জায়েয নয়। কিন্তু শিং ভাঙার কারণে যদি মস্তিষ্কে আঘাত না পৌঁছে তাহলে সে পশু দ্বারা কুরবানী করা জায়েয। তাই যে পশুর শিং অর্ধেক বা কিছু অংশ ফেটে বা ভেঙে গেছে কিংবা শিং একেবারেই ওঠেনিসে পশু দ্বারা কুরবানী করা জায়েয। -জামে তিরমিযী ১/২৭৬সুনানে আবু দাউদহাদীস ৩৮৮বাদায়েউস সানায়ে ৪/২১৬ফাতাওয়া হিন্দিয়া ৫/২৯৭রদ্দুল মুহতার ৬/৩২৪

মাসআলা : যে পশুর লেজ বা কোনো কান অর্ধেক বা তারও বেশি কাটা সে পশু কুরবানী করা জায়েয নয়। আর যদি অর্ধেকের কম হয় তাহলে তা কুরবানী করা জায়েয। তবে জন্মগতভাবেই যদি কান ছোট হয় তাহলে অসুবিধা নেই। -জামে তিরমিযী ১/২৭৫মুসনাদে আহমাদ ১/৬১০ইলাউস সুনান ১৭/২৩৮ফাতাওয়া হিন্দিয়া ৫/২৯৭-২৯৮ফাতাওয়া খানিয়া ৩/৩৫২

কুরবানীর পশু নিজে যবাই করা

আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. বলেন-

كان يذبح أضحيته بالمصلى يوم النحر، وذكر أن النبي صلى الله عليه وسلم كان يفعله.

আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নহরের দিন ঈদগাহে পশু কুরবানী করতেন।

তিনি আরও উল্লেখ করেন যেনবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই যবাই করতেন। -মুসনাদে আহমাদহাদীস ৫৮৭৬

আনাস ইবনে মালেক রা.-এর বর্ণনায় আছে-

أَنَّهُ رَأَى النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ذَبَحَ أُضْحِيَّتَهُ بِيَدِهِ، وَكَانَ يُكَبِّرُ عَلَيْهَا.

অর্থাৎ তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তাকবীর বলতে বলতে নিজ হাতে কুরবানীর পশু যবাই করতে দেখেছেন। -মুসনাদে আহমাদহাদীস ১২৪৬৬

উটগরু বা মহিষে অংশিদার হওয়া

উটগরু বা মহিষে এক থেকে সাত পর্যন্ত যেকোনো ভাগেই কুরবানী করা যায়। আর ভেড়াদুম্বা বা ছাগল একজনের পক্ষ থেকে কুরবানী করা যায়। একাধিক অংশে তা কুরবানী করা জায়েয নয়।

জাবের ইবনে আবদুল্লাহ রা. বলেন-

خَرَجْنَا مَعَ رَسُولِ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ مُهِلِّينَ بِالْحَجِّ : فَأَمَرَنَا رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ أَنْ نَشْتَرِكَ فِي الْإِبِلِ وَالْبَقَرِ، كُلّ سَبْعَةٍ مِنّا فِي بَدَنَةٍ.

আমরা হজ্বের ইহরাম বেঁধে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে বের হলাম। তিনি আমাদেরকে প্রতি উট ও গরুতে সাতজন করে শরীক হয়ে কুরবানী করার আদেশ করলেন। -সহীহ মুসলিমহাদীস ১৩১৮

অপর হাদীসে এসেছেরাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনএকটি গরু সাত জনের পক্ষ থেকে এবং একটি উট সাত জনের পক্ষ থেকে (কুরবানী করা হবে)। -সহীহ ইবনে হিব্বানহাদীস ৪০০৬সহীহ ইবনে খুযাইমাহাদীস ২৯০১জামে তিরমিযীহাদীস ৯০৪সুনানে আবু দাউদহাদীস ২৮০৮

এই হাদীসে একটি উট ও গরু সাতজনের পক্ষে যথেষ্ট হওয়ার কথা আছে। তাই অধিকাংশ আহলে ইলমের মতেউট বা গরু সর্বোচ্চ সাতজনের পক্ষ থেকে কুরবানী করা জায়েয।

আলী রা.আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা.আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. ও আয়েশা রা. থেকে এমনটি বর্ণিত আছে।

এছাড়া আতা রাহ.তাওস রাহ.সালেম রাহ.হাসান রাহ. ও আমর ইবনে দীনার রাহ.ছাওরী রাহ.আওযায়ী রাহ.শাফেয়ী রাহ.আবু ছাওর রাহ. ও হানাফীগণও অনুরূপ বলেন।

তবে ওমর রা.-এর মতেএকটি প্রাণী সাতজনের পক্ষে যথেষ্ট হতে পারে না। ইমাম মালেক রাহ.-ও অনুরূপ মত পোষণ করেন।

ইমাম আহমাদ রাহ. বলেনসাতজনের পক্ষ থেকে একটি প্রাণী যথেষ্ট না হওয়ার মতটি ওমর রা. ব্যতীত অন্য কেউ পোষণ করেন বলে আমার জানা নেই। -আলমুগনীইবনে কুদামা ১৩/৩৬৪

মাসআলা : উটগরুমহিষ সাত ভাগে এবং সাতের কমে যেকোনো সংখ্যা যেমন দুইতিনচারপাঁচ ও ছয় ভাগে কুরবানী করা জায়েয। অর্থাৎ কুরবানীর পশুতে এক সপ্তমাংশ বা এর অধিক যে কোনো অংশে অংশীদার হওয়া জায়েয। এক্ষেত্রে ভগ্নাংশ  যেমনদেড় ভাগআড়াই ভাগসাড়ে তিন ভাগ হলেও কোনো সমস্যা নেই। -বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৭

একটি দুম্বা বা ছাগল গোটা পরিবারের পক্ষে যথেষ্ট নয়

উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. বলেন-

أنّ رَسولَ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ  أمَرَ بكَبْشٍ أقْرَنَ يَطَأُ في سَوادٍ، ويَبْرُكُ في سَوادٍ، ويَنْظُرُ في سَوادٍ، فَأُتِيَ به لِيُضَحِّيَ به، فَقالَ لَهايا عائِشَةُ، هَلُمِّي المُدْيَةَ، ثُمَّ قالَاشْحَذِيها بحَجَرٍ، فَفَعَلَتْثُمَّ أخَذَها، وأَخَذَ الكَبْشَ فأضْجَعَهُ، ثُمَّ ذَبَحَهُ، ثُمَّ قالَباسْمِ اللهِ، اللَّهُمَّ تَقَبَّلْ مِن مُحَمَّدٍ، وآلِ مُحَمَّدٍ، ومِن أُمَّةِ مُحَمَّدٍ، ثُمَّ ضَحّى بهِ.

আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানী করার জন্য বড় শিং এবং দুই পাহাঁটু ও চোখের আশপাশে কালো বর্ণ বিশিষ্ট একটি দুম্বা সংগ্রহের আদেশ করলেন। অতঃপর তা আনা হলে তিনি আমাকে বললেনহে আয়েশা! ছুরি নিয়ে আসো। অতঃপর বললেনপাথর দিয়ে তা ধার দাও। আমি তা করলাম। অতঃপর তিনি তা নিলেন এবং দুম্বাটিকে ধরে শোয়ালেন। এরপর-

باسْمِ اللهِ، اللّهُمَّ تَقَبَّلْ مِن مُحَمَّدٍ، وآلِ مُحَمَّدٍ، ومِن أُمَّةِ مُحَمَّدٍ .

বলতে বলতে তা যবাই করলেন। -সহীহ মুসলিমহাদীস ১৯৬৭সুনানে আবু দাউদহাদীস ২৭৯২

হাদীসে-

اللّهُمَّ تَقَبَّلْ مِن مُحَمَّدٍ، وآلِ مُحَمَّدٍ.

(হে আল্লাহ! আপনি তা মুহাম্মাদ ও মুহাম্মাদের পরিবারের পক্ষ থেকে কবুল করুন।) শব্দ থেকে বোঝা যায়একটি কুরবানী ব্যক্তি ও তার পরিবারের সকলের পক্ষ থেকে গৃহিত হয়।

হাদীসের ব্যাখ্যা

এই হাদীসের ব্যাখ্যায় শাইখুল ইসলাম মুফতী তাকী উসমানী দামাত বারাকাতুহুম বলেনকুরবানীতে ব্যক্তির সাথে তার পরিবার-পরিজনদের অংশীদার হওয়ার দুটি অর্থ হতে পারে। যথা :

১. কুরবানী একজনের পক্ষ থেকেই আদায় হবে। তবে কুরবানীদাতা তার কুরবানীর সওয়াবটুকু অন্যদেরকে হাদিয়া করে দিবেন।

২. দ্বিতীয় অর্থ হলকুরবানীর ছাগলের মালিকানার মধ্যেই অংশীদারিত্ব সাব্যস্ত হবে এবং তা দ্বারা একাধিক ব্যক্তির কুরবানী আদায় হয়ে যাবে।

অন্যান্য দলীলের আলোকে ইমাম আবু হানীফা রাহ. এই হাদীসে প্রথম অর্থেই পরিবার-পরিজনদের শরীক হওয়া উদ্দেশ্য নিয়েছেন। অর্থাৎ ব্যক্তির সাথে তার পরিবার-পরিজন শুধু কুরবানীর সওয়াবে অংশীদার হবে। মূল কুরবানীতে নয়। -তাকমিলা ফাতহুল মুলহিম ৩/৫৬৪

কুরবানীর গোশত জমিয়ে রাখা

মদীনাযুগের প্রথম দিকে একবার খাদ্য সংকট দেখা দেয়। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন সাহাবায়ে কেরামকে তিন দিনের বেশি কুরবানীর গোশত সংরক্ষণ করে রাখতে নিষেধ করেছিলেন। পরে সংকট দূর হলে তিনি আবার সংরক্ষণ করে রাখার অনুমতি দেন।  জাবের রা. বলেন-

نَهَى النّبِيِّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ  عَنْ أَكْلِ لُحُومِ الضّحَايَا بَعْدَ ثَلَاثٍ، ثُمّ قَالَ بَعْدُكُلُوا، وَتَزَوّدُوا، وَادّخِرُوا.

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিন দিনের পর কুরবানীর গোশত খেতে নিষেধ করেছিলেন। এরপর (অবকাশ দিয়ে) বললেনখাওপাথেয় হিসেবে সঙ্গে নাও এবং সংরক্ষণ করে রাখ। -সহীহ মুসলিমহাদীস ১৯৭২

আবু মূসা আশআরী রা. বলেনআল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

نَهَيْتُكُمْ عن زِيارَةِ القُبُورِ فَزُورُوها، ونَهَيْتُكُمْ عن لُحُومِ الأضاحي فَوْقَ ثَلاثٍ، فأمْسِكُوا ما بَدا لَكُم....

আমি তোমাদেরকে কবর যিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম। এখন তোমরা তা যিয়ারত কর। তোমাদেরকে কুরবানীর গোশত তিন দিনের পরে খেতে নিষেধ করেছিলাম। এখন তোমাদের খুশিমতো তা সংরক্ষণ করে রাখ। ... -সহীহ মুসলিমহাদীস  ১৯৭৭সহীহ ইবনে হিব্বানহাদীস ৫৩৯১৫৪০০সুনানে নাসায়ীহাদীস ২০৩৩সুনানে আবু দাউদহাদীস ৩৬৯৮   

সুলাইমান ইবনে বুরায়দা রাহ. নিজ পিতার সূত্রে বর্ণনা করেনআল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

كنت نهيتكم عن لحوم الأضاحي فوق ثلاث ليتسع ذو الطول على من لا طول له، فكلوا ما بدا لكم، وأطعموا وادخروا.

আমি তোমাদেরকে তিন দিনের পর কুরবানীর গোশত খেতে নিষেধ করেছিলামযেন স্বচ্ছল লোকেরা অসচ্ছলকে উদারভাবে তা দিতে পারে। এখন তোমরা যত খুশি খাওঅন্যকে খাওয়াও এবং সঞ্চয় করে রাখ। -জামে তিরমিযীহাদীস ১৫১০

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাঁর সন্তুষ্টির জন্যই কুরবানী করার তাওফীক দান করুন। সকল ভুল-ত্রুটি থেকে রক্ষা করুন এবং আমাদের পক্ষ থেকে তা কবুল করুনআমীন।

সূত্রঃ- মাসিক আল কাউসার

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url